বিশেষ প্রতিনিধি, বিশেষ প্রতিনিধি।।
ডেস্ক নিউজ:
রোববার (২৭ এপ্রিল) কাতার ভিত্তিক গণমাধ্যম আল-জাজিরার ‘টক টু আল-জাজিরা’ অনুষ্ঠানটির বিশেষ পর্ব ‘মুহাম্মদ ইউনূস: রিয়েল রিফর্ম অর জাস্ট আ নিউ রুলিং ক্লাস ইন বাংলাদেশ’ শিরোনামে এক সাক্ষাৎকার প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এসময় তিনি বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারকে বাংলাদেশের জনগণ এখনও ভালো সমাধান মনে করছে’
অনুষ্ঠানে উপস্থাপক ড. ইউনূসকে বলেন, শেখ হাসিনার পতনের পরের ‘মধুচন্দ্রিমা’র সময়টুকু সম্ভবত শেষ হয়েছে। এখন বড় বড় বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে, যেগুলোর সুনির্দিষ্ট জবাব আপানার দেওয়া উচিত। কারণ, পুরোনো ক্ষমতাধরদের প্রভাব রয়েছে, অন্যরা রাজনৈতিক শূন্যতাকে কাজে লাগাতে চাইতে পারে। যেমন লাখ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী রয়েছে। এসবের সমাধান কি বাংলাদেশ একা করতে পারবে?
জবাবে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘দুটি বিষয়, একটি জনগণের অধৈর্য নিয়ে, তা মধুচন্দ্রিমা শেষ হোক বা না হোক। বাংলাদেশের পরিস্থিতি দেখে এখনও মানুষ মনে করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এখনও তাদের জন্য ভালো সমাধান। তারা বলছে না, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে যেতে দাও। আমরা এমন কোনো সমস্যার মুখোমুখি হইনি যেখানে লোকেরা বলছে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ক্ষমতা হস্তান্তর করো।’
রোহিঙ্গা সঙ্কট প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমরা আন্তর্জাতিক সংস্থা, জাতিসংঘের সাথে রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে কাজ করছি এবং এই লোকেরা যাতে নিরাপদে বাড়ি ফিরে যেতে পারে, তা নিশ্চিত করার জন্যও কাজ করছি। আমাদের চিন্তা হলো, কীভাবে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে কিছু বোঝাপড়া তৈরি করা যায়, যাতে রোহিঙ্গারা তাদের নিজেদের বাড়িতে ফিরে যেতে এবং নিরাপদ পুনর্বাসন করতে পারে।’
এরপর নির্বাচন প্রসঙ্গে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বিগত দিনের অনিয়ম–দুর্নীতি দূর করে দেশে অর্থবহ সংস্কার এবং এযাবৎকালের সেরা নির্বাচন উপহার দেওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, নির্বাচনের আগে সংস্কারের তালিকা ছোট হলে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন এবং তালিকা বড় হলে আগামী বছর জুনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচন জুনের পরে যাবে না।
সাক্ষাৎকারে আল জাজিরার সাংবাদিক নিয়েভ বার্কার শেখ হাসিনার ভারতে অবস্থানের বিষয়ে ড. ইউনূসের বক্তব্য জানতে চান। এ সময় তিনি বলেন, বিমসটেক সম্মেলনের ফাঁকে নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বৈঠকে শেখ হাসিনাকে নিষ্ক্রিয় রাখার অনুরোধ করেছিলেন। তবে মোদি জানান, ভারতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম উন্মুক্ত থাকায় শেখ হাসিনার বক্তব্য নিয়ন্ত্রণ করা তার পক্ষে সম্ভব নয়।
আল জাজিরা সাংবাদিক জানতে চেয়েছিলেন, শেখ হাসিনা নিজেকে এখনও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী দাবি করে ভারতে থেকে বিবৃতি দিচ্ছেন। অন্তর্বর্তী সরকার এটিকে কীভাবে দেখে?
জবাবে ড. ইউনূস বলেছেন, ব্যাংককে অনুষ্ঠিত বিমসটেক সম্মেলনে মোদির সঙ্গে আমার আলোচনায় আমি স্পষ্ট করেছিলাম, শেখ হাসিনাকে ভারতে রাখতে চাইলে তা আপনার ইচ্ছা। কিন্তু তার উচিত নয় বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে মন্তব্য করা। তার বক্তব্য জনগণকে উত্তেজিত করছে এবং আমাদের জন্য সমস্যা তৈরি করছে।
তখন নিয়েভ বার্কার জানতে, মোদি কী বলেছিলেন?
তখন ড. ইউনূস বলেন, তিনি বলেছিলেন, ভারতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সবার জন্য উন্মুক্ত। সেখানে কারও বক্তব্য নিয়ন্ত্রণ করা তার পক্ষে সম্ভব নয়।
আল জাজিরা সাংবাদিক প্রশ্ন করেন, অর্থাৎ আপনি বলছেন, মোদি বলেছেন ভারতে বাকস্বাধীনতা বন্ধ করতে পারবেন না। ফলে শেখ হাসিনাকে ফেরানোর কোনও নিশ্চয়তাও পাননি। এ অবস্থায় বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের কী প্রভাব পড়বে?
প্রধান উপদেষ্টা এই প্রশ্নের জবাবে বলেন, এটা আমাদের দ্বিপক্ষীয়ভাবে সমাধান করতে হবে। আমরা আমাদের আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করছি। ভারতের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে ফেরত চাওয়া হয়েছে, তবে এখনো কোনও সাড়া পাইনি। আইনি প্রক্রিয়া এগিয়ে গেলে বিষয়টি উচ্চপর্যায়ে উঠবে।
সাক্ষাৎকারে অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত দল আওয়ামী লীগের নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিষয়ে প্রশ্নের জবাবে ড. ইউনূস বলেছেন, এটি দলের (আওয়ামী লীগ) উপর নির্ভর করবে — তারা অংশগ্রহণ করবে কি না। আমরা এখনও জানি না; তারা কিছু ঘোষণা করেনি। যখন তারা করবে, নির্বাচন কমিশন এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ উপযুক্ত পদক্ষেপ নেবে।
এই বিষয়টি নির্বাচন কমিশনের ওপর ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে কিনা প্রশ্নের জবাবে প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, শুধু নির্বাচন কমিশন নয়। অন্যান্য দল বা আইনগত বিধানও এর মধ্যে আসতে পারে, যার অধীনে তাদের অংশগ্রহণের অনুমতি নাও হতে পারে।
ভারতের আগে চীন সফর করার সিদ্ধান্ত কি ইচ্ছাকৃত কি না ও এর মাধ্যমে কোনও বার্তা দিতে চেয়েছেন, এমন প্রশ্নের জবাবে ড. ইউনূস বলেন, আমি আমার প্রতিবেশী দেশগুলোকেই সফর করছি। ভারতে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলাম, সাড়া পাইনি। তাই প্রথমে চীন গেলাম। এরপর মালয়েশিয়া যাবো। এর আগে থাইল্যান্ডের ব্যাংককেও ছিলাম। আমি আশেপাশের অনেক দেশেই সফর করছি এবং চেষ্টা করছি দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর সংগঠন সার্ককে আবার সক্রিয় করতে। সার্ক এখন অচল অবস্থায় রয়েছে। আমি সব সার্ক নেতাদের আহ্বান জানাচ্ছি—চলুন একসঙ্গে কাজ করি, আবার যোগাযোগ বাড়াই। একইসঙ্গে বিমসটেক নিয়েও কাজ করছি। বলছি, আসুন একত্র হই, সমস্যা মেটাই এবং এগিয়ে চলি। মূল লক্ষ্য হলো—দেশগুলোকে একত্র করে মানুষের জীবনমান উন্নত করা। বর্তমানে বাংলাদেশ বিমসটেকের চেয়ারম্যান, তাই এই দায়িত্ব গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি আমরা আসিয়ান সদস্যপদ পাওয়ার চেষ্টা করছি। ইতিমধ্যে ইতিবাচক সাড়া পেয়েছি।
এ সময় সাংবাদিক জানতে চান, আপনি আঞ্চলিকভাবে যার সঙ্গে সম্ভব, তার সঙ্গে কাজ করতে প্রস্তুত। তবে ভারত কিছুটা উদাসীনতা দেখিয়েছে। এখন কি পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক গভীর করার দিকে ঝুঁকছেন?
এর জবাবে ড. ইউনূস বলেন, আমি ‘উদাসীনতা’ বলবো না। এটা সাময়িক একটা বিষয়। আমাদের একসঙ্গে সমাধান করতে হবে। আমি এটাকে চূড়ান্ত বা দীর্ঘস্থায়ী কিছু মনে করি না। বন্ধুত্বই টিকে থাকার চাবিকাঠি। আমি প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ার ওপর জোর দিচ্ছি। ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক বিশ্বের সেরা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কগুলোর একটি হওয়া উচিত।
নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে অংশগ্রহণের অনুমতি দেওয়া হবে কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এই প্রশ্নের জবাবের একটি অংশ আওয়ামী লীগকেই নির্ধারণ করতে হবে। দলটি আগে নিজেই সিদ্ধান্ত নেবে তারা নির্বাচনে যোগ দেবে কি না। তারা এখনও কিছু ঘোষণা করেনি। তা ছাড়া নির্বাচনের সময় নির্বাচন কমিশন কী প্রতিক্রিয়া দেয়, সেটাসহ অন্যান্য বিষয় রয়েছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
এরপর উপস্থাপক প্রশ্ন করেন, তাহলে লীগের নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বিষয়টি নির্বাচন কমিশনের ওপর ছেড়ে দিচ্ছেন কি না?
জবাবে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, সেটা নয়। অন্যান্য দল আছে- যারা বলতে পারে যে এই আইনের অধীনে তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবে না।