| ০৮ জুন ২০২৫

ফারাক্কা বাঁধে মরণদশা দেশের শতাধিক নদীর

রিপোর্টারের নামঃ ডেস্ক নিউজ
  • আপডেট টাইম : 15-05-2025 ইং
  • 31215 বার পঠিত
ফারাক্কা বাঁধে মরণদশা দেশের শতাধিক নদীর
ছবির ক্যাপশন: ফারাক্কা বাঁধে মরণদশা দেশের শতাধিক নদীর

ডেস্ক নিউজ: 

ফারাক্কার বিরূপ প্রভাবে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিস্তীর্ণ জনপদের প্রাণ-প্রকৃতি, জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। পানির অভাবে মারা গেছে অনেক নদ-নদী। এখনো শতাধিক নদ-নদীর মরণ দশা। এর ফলে ভূগর্ভস্থ পানিস্তর দ্রুত নিচে নেমে যাচ্ছে। বেড়ে যাচ্ছে কৃষি উৎপাদনের খরচ। উজানের পানির অভাবে সাগর থেকে আসা লোনা পানি ক্রমেই উত্তরের জমি গ্রাস করছে। সুপেয় পানির অভাবে উপকূলীয় এলাকা ছাড়ছে মানুষ। লাখো মানুষ অবর্ণনীয় কষ্টে জীবন কাটাচ্ছে। জলবায়ু হয়ে উঠছে চরমভাবাপন্ন।

পশ্চিম হিমালয়ের গঙ্গোত্রী হিমবাহ থেকে উৎপন্ন গঙ্গা নদীর দৈর্ঘ্য ২ হাজার ৭০৪ কিলোমিটার। বিশ্বের অন্যতম প্রধান এই নদীটি বাংলাদেশে ‘পদ্মা’ নামে পরিচিত। কলকাতা বন্দর রক্ষার কথা বলে ভারত পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মালদহ ও মুর্শিদাবাদের ফারাক্কা পয়েন্টে গত শতাব্দীর ষাটের দশকে বাঁধ নির্মাণ শুরু করে। এর লক্ষ্য ছিল পদ্মাকে বঞ্চিত করে ভাগীরথী-হুগলি নদীতে পানি সরবরাহ করা। এর জন্য ৪০ কিলোমিটার দীর্ঘ ফিডার ক্যানেলও তৈরি করে দেশটি। কিন্তু ১৯৭৫ সালে ফারাক্কা বাঁধ চালুর পর দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল ক্রমেই পানিশূন্য হতে থাকে। এরপর থেকে দেখা দিতে থাকে নানা ধরনের বিপর্যয়।

স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর ১৯৭৫ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর আলোচনার পর ভারতকে ফারাক্কা পয়েন্টে ১০ দিনের জন্য পরীক্ষামূলক ৩১০ থেকে ৪৫০ কিউসেক পানি প্রত্যাহারের অনুমোদন দেওয়া হয়। কিন্তু সেই পরীক্ষার ‘১০ দিন’ আজও শেষ হয়নি।

ভারতকে পানি প্রত্যাহারে বিরত রাখতে ব্যর্থ হয়ে বাংলাদেশ বিষয়টি জাতিসংঘে উপস্থাপন করে। জাতিসংঘের প্রস্তাব অনুযায়ী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের শাসনামলে ১৯৭৭ সালের ৫ নভেম্বর ভারত-বাংলাদেশ প্রথম পাঁচ বছরমেয়াদি পানিবণ্টন চুক্তি হয়। এরপর কয়েক দফা স্বল্পমেয়াদি চুক্তি হলেও ১৯৮৯ সালের শুষ্ক মৌসুম থেকে ভারত একতরফা পানি প্রত্যাহার করতে থাকে। এরপর ১৯৯৬ সালের চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশকে সর্বনিম্ন ৩৫ হাজার কিউসেক পানি দিতে বাধ্য ভারত। কিন্তু ভারত চুক্তি লঙ্ঘন করে গঙ্গা নদীর পানি ইচ্ছানুযায়ী প্রত্যাহার করে। ফলে বাংলাদেশের হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টে প্রমত্তা পদ্মা শুষ্ক মৌসুমে পানির অভাবে সরু খালে পরিণত হয়।

বিলুপ্ত বহু নদী, ধুঁকছে অনেকগুলো

পদ্মায় পানি না থাকায় প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশের গোটা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নদ-নদীর ওপর। বিশাল এই নদীর প্রধান দুই শাখা গড়াই (মধুমতি) ও মাথাভাঙ্গা শুষ্ক মৌসুমে কার্যত পানিশূন্য হয়ে যায়। এর ফলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের শতাধিক নদ-নদীর মরণ দশা হয়েছে।

এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের দীর্ঘতম নদী ভৈরব ও কপোতাক্ষ, কুমার, চিত্রা, বেত্রাবতী (বেতনা), হরিহর, ভদ্রা, ফটকি, নবগঙ্গা, মুক্তেশ্বরী, কোদলা, টেকা, বেগবতী প্রভৃতি। এই নদীগুলোর বেশিরভাগ শুষ্ক মৌসুমে পুরোপুরি শুকিয়ে যায়।

আবার পানি প্রবাহের প্রাকৃতিক নিয়মের ব্যত্যয় ঘটায় পলি জমে বর্ষায় দুই কূল উপচে ফসলি জমি ভাসিয়ে দেয়। ছোট স্রোতধারার মধ্যে বেতনা, আফ্রা, মুক্তেশ্বরী, হরিহর, হাপরখালী, কোদলা, শ্রীহরি, টেকা, হাকর, আতাই, কোদালিয়া, আমড়াখালী, দায়তলা প্রভৃতি নদীর অনেকগুলোই অস্তিত্ব হারিয়েছে। আর বাকিগুলো বিলুপ্তির পথে। পানিশূন্য এসব নদীর বুকে বোরো মৌসুমে ধান চাষ করেন কৃষক।

বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (সেচ) আব্দুল্লাহ আল রশিদ মনে করেন, নদ-নদীগুলো পানিশূন্য হয়ে পড়ার প্রধান কারণ ফারাক্কা বাঁধ। ফারাক্কা পয়েন্টে ভারত একতরফা পানি প্রত্যাহার করে নেওয়ায় দক্ষিণ-পশ্চিম জনপদের প্রাণ-প্রকৃতি, নদ-নদীর ওপর ব্যাপক বিরূপ প্রভাব পড়েছে। এখন এ অঞ্চলে চাষাবাদের জন্য মূলত ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভর করতে হয়।

ভৈরব নদ সংস্কার আন্দোলনের উপদেষ্টা ইকবাল কবির জাহিদ বলেন, শুধু গঙ্গাই নয়, এ অঞ্চলের আরেকটি প্রধান নদী ভৈরবেও বাঁধ দিয়ে ভারত একতরফা পানি প্রত্যাহার কর নিচ্ছে। ভারতের হাদড়াগাড়িতে এ বাঁধটি দেওয়া হয়েছে।

নৌযোগাযোগ কার্যত বিলুপ্ত

দেশের অন্যান্য স্থানের মতো দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সভ্যতা, শহর-নগর-বাণিজ্যকেন্দ্রগুলো গড়ে উঠেছে নদীতীরবর্তী স্থানে। হাজার বছর ধরে এসব জনপদে যাতায়াত ও বাণিজ্যের প্রধান পথ ছিল নদী। কিন্তু পানির অভাবে নদ-নদী শুকিয়ে যাওয়ায় এখন নৌযোগাযোগ মূলত বাগেরহাট, খুলনা ও সাতক্ষীরার কিছু এলাকায় সচল আছে। নড়াইল ও যশোরের দক্ষিণাংশে কিছু নৌযান চললেও তা মূলত পণ্য পরিবহনে ব্যবহৃত হয়। ভৈরব নদে নাব্য সংকটের কারণে যশোরের নৌবন্দর নওয়াপাড়ায় বড় নৌযান আসতে পারে না। সেখানে ছোট ছোট নৌযানে পণ্য পরিবহন করায় খরচ ও সময় বেশি ব্যয় হয়। সামগ্রিকভাবে নৌযোগাযোগ সংকুচিত হয়ে যাওয়ায় তার স্থান দখল করে মূলত সড়ক যোগাযোগ। এর ফলে মানুষের যাতায়াত ও পণ্য পরিবহনে খরচ বেড়েছে কয়েকগুণ।

প্রাণ-প্রকৃতি ও নদী আন্দোলনের বর্ষীয়ান নেতা অনিল বিশ্বাস বলেন, ‘১৯৮১ সালে কপোতাক্ষ নদে লঞ্চে চেপে ঝিকরগাছা থেকে গঙ্গানন্দপুর গেছি। ১৯৯১ সালে বাঁকড়া বাজার থেকে কপোতাক্ষের তাজা ইলিশ কিনেছি। এ কথা বিশ্বাস করতে আজকের প্রজন্মের কষ্ট হবে। আমাদের চোখের সামনে মরে গেল দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের দীর্ঘতম নদ কপোতাক্ষ।’

ভূগর্ভস্থ পানিস্তর নিম্নমুখী

দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ঠিক মাঝের জেলা যশোর। এ জেলার ওপর দিয়ে বয়ে গেছে ২০টি নদী। পানি উন্নয়ন বোর্ড যশোরের নির্বাহী প্রকৌশলী পলাশ কুমার ব্যানার্জী বলেন, নদীগুলো মজে যাওয়ায় শুষ্ক মৌসুমে কৃষক সেচের জন্য ভূ-উপরিস্থ পানি পায় না। ফলে ফসল বাঁচাতে তাদের ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভর করতে হয়। এর ফল হচ্ছে মারাত্মক। দিন দিন পানিস্তর নেমে যাচ্ছে। ফলে চাষাবাদের খরচ বাড়ছে হু হু করে।

বিএডিসির তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (সেচ) আব্দুল্লাহ আল রশিদ জানান, এ অঞ্চলে মাটির ২৫ ফুট গভীরে পানিস্তর থাকলে তাকে স্বাভাবিক বলা যায়। কিন্তু এবার শুষ্ক মৌসুমের শুরুতে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে পানিস্তর গড়ে প্রায় ৩১ ফুট নিচে নেমে যায়। প্রতি বছরই এমনটি হচ্ছে। ফলে অগভীর নলকূপে পানি ওঠে না। বিএডিসি ও চাষিরা বাধ্য হয়ে মাটি খুঁড়ে মোটর স্থাপন করেন। এতে বিপুল অঙ্কের টাকা বাড়তি খরচ হচ্ছে।

বিএডিসির দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের হেডকোয়ার্টার যশোর শহরের কাছে চাঁচড়া এলাকায় অবস্থিত। এ এলাকার শহরের বাসিন্দারা অগভীর নলকূপে একেবারেই পানি পান না। তাদের হয় পৌরসভার সাপ্লাই পানি, না হয় নিজস্ব সাবমার্সিবল পাম্পের ওপর নির্ভর করতে হয়।

পানিতে অস্বাভাবিক লবণাক্ততা, কমছে ফসলি জমি

উজান থেকে পানির প্রবাহ ক্ষীণ হয়ে পড়ায় দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের পানি ক্রমেই উত্তরের দিকে উঠে আসছে। ফলে দক্ষিণ-পশ্চিমের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের পানি ও মাটি এখন মাত্রাতিরিক্ত লবণাক্ত। দিন দিন এই লবণাক্ততার পরিমাণ বাড়ছে।

বাংলাদেশ মৃত্তিকাসম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের মতে, যেসব কারণে দক্ষিণাঞ্চলের মাটি ও পানিতে লবণাক্ততা বাড়ছে, তার মধ্যে প্রধান হলো উজানের পানি (গঙ্গা) প্রত্যাহার। ফারাক্কার কারণে গাঙ্গেয় অববাহিকায় সর্বোচ্চ লবণাক্ততার প্রকোপ দেখা গেছে।

ইনস্টিটিউটের যশোর কার্যালয়ের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. মোতাসীম আহম্মেদ বলেন, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মাটি ও পানিতে লবণাক্ততা অস্বাভাবিক বাড়ার মুখ্য কারণ ফারাক্কা বাঁধের মাধ্যমে গঙ্গা নদীর পানির একতরফা প্রত্যাহার। চার জেলার আটটি পয়েন্ট থেকে ভূউপরিস্থ পানির নমুনা সংগ্রহ করে দেখা গেছে, লবণাক্ততার পরিমাণ ১০ থেকে ৩৫ ডেসিসিমেন/মিটার পর্যন্ত; যা ফসল চাষ ও পানের একেবারেই অযোগ্য।

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট সাতক্ষীরার ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. শিমুল মণ্ডল বলেন, উপকূলে এখন আমন চাষ হয় না বললেই চলে। গ্রীষ্ম মৌসুম মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত গোটা এলাকাই ফসলশূন্য থাকছে।

সুপেয় পানির জন্য হাহাকার

গত কয়েক বছর ধরে দক্ষিণ-পশ্চিমের তিন জেলা সাতক্ষীরা, খুলনা ও বাগেরহাটের উপকূলীয় এলাকায় সুপেয় পানির জন্য হাহাকার সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে আইলা ও সিডরে উপকূলীয় বাঁধ তছনছ হয়ে যাওয়ায় লাখ লাখ মানুষ সুপেয় পানির সংকটে ধুঁকছে। এর মধ্যে সাতক্ষীরার উপকূলীয় শ্যামনগর, কালিগঞ্জ, দেবহাটা, খুলনার কয়রা, পাইকগাছাসহ আশপাশের এলাকার অবস্থা সবচেয়ে খারাপ। ওইসব অঞ্চলে এক কলস পানযোগ্য পানি সংগ্রহ করতে গৃহবধূদের মাইলের পর মাইল পাড়ি দিতে হয়।

জমি হারাচ্ছে উর্বরতা, খরচ বাড়ছে কৃষিতে

বিশেষজ্ঞদের মতে, পৃথিবীর নদীগুলো সারা বছর যে পলি বয়ে আনে, তার সিংহভাগই বহন করে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে যাওয়া তিনটি নদী পদ্মা, যমুনা ও মেঘনা। এই তিন প্রধান স্রোতধারার শাখা-প্রশাখাগুলোর বহন করা পলি জমি উর্বর করে। কিন্তু ফারাক্কা বাঁধ চালুর কারণে পদ্মার পলি বহনক্ষমতা মারাত্মকভাবে কমে গেছে। যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. জাভেদ হোসেন খান বলেন, এর ফলে জমি প্রাকৃতিক উর্বরতা হারাচ্ছে। এখন রাসায়নিক সার ব্যবহার ছাড়া কোনো জমিতে কার্যত ফসল চাষ করা সম্ভব নয়।

একসময় নদী-খাল-বিলে পর্যাপ্ত পানি থাকায় চাষিরা সেউচির (অযান্ত্রিক পদ্ধতি) মাধ্যমে জমিতে সেচ দিত। কিন্তু ভূউপরিস্থ পানির সংকটের কারণে গত শতাব্দীর আশির দশকে মূলত ভূগর্ভস্থ সেচব্যবস্থা চালু হয়। যন্ত্রনির্ভর এই সেচব্যবস্থা ব্যাপক ব্যয়বহুলও। এর ফলে বেড়েছে কৃষি উৎপাদনের খরচ, বেড়েছে উৎপাদিত কৃষিপণ্যের দামও।

কৃষিবিদদের মতে, ফসলের মাঠে ভূউপরিস্থ পানি ব্যবহার করলে জমির স্বাস্থ্য ভালো থাকে। ভূগর্ভস্থ পানি জমির উর্বরতা কমায়। ফলে ভালো ফসল উৎপাদন করতে কৃষককে এখন সারসহ নানা খাতে বিপুল টাকা খরচ করতে হয়। এ ছাড়া সাতক্ষীরা, খুলনা ও বাগেরহাটের উপকূলীয় এলাকার পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, চিংড়িসহ লবণ-পানির মাছ চাষ করা ছাড়া কোনো কৃষি উৎপাদন একপ্রকার অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে।

জলাবদ্ধতার শিকার হচ্ছে মানুষ

যশোরের অভয়নগর, কেশবপুর ও মণিরামপুর উপজেলার মধ্যবর্তী একটি এলাকার নাম ‘ভবদহ’। এই ভবদহকে যশোর-খুলনার অভিশাপ বলা হয়। গত আশির দশক থেকে ভবদহ-সংলগ্ন যশোরের ওই তিন উপজেলা, খুলনার ডুমুরিয়া এবং সাতক্ষীরার তালা জলাবদ্ধতার শিকার। এর প্রধান দুটি কারণের একটি হলো ফারাক্কা বাঁধের মাধ্যমে উজানের পানি প্রত্যাহার এবং ষাটের দশকে তখনকার ওয়াপদা কর্তৃক উপকূলজুড়ে অসংখ্য বাঁধ, পোল্ডার, স্লুইস গেট নির্মাণ। এর ফলে উজানের পানির প্রবাহ কমে যাওয়া, সাগরের লোনা পানির প্রবাহ দেশের গভীর অভ্যন্তরে প্রবেশ করে; যার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি নদীগুলোয় পলি পড়ে মজে যাওয়া।

ভবদহ এলাকার জলাবদ্ধতা থেকে লাখো মানুষকে মুক্তি দিতে এবং মজে যাওয়া নদীগুলো খননে পানি উন্নয়ন বোর্ড শত শত কোটি টাকা খরচ করেও সমস্যার সমাধান করতে পারছে না। জলাবদ্ধ এলাকায় ধানসহ অন্যান্য ফসলের উৎপাদন প্রতি বছর কমছে। উপকূল থেকে বিস্তৃত হতে হতে এখন যশোর-নড়াইল অঞ্চলও হাজার হাজার লোনা পানির চিংড়ি ঘেরে ছেয়ে গেছে।

ঘটছে বিপন্ন প্রাণ-প্রকৃতির বিপর্যয়

ফারাক্কার কারণে দক্ষিণ-পশ্চিমের নদ-নদী পানিশূন্য হওয়া ও লোনা পানি বিস্তারের কারণে বিপর্যয় ঘটছে প্রাণ-প্রকৃতি আর উদ্ভিদের। বাস্তুচ্যুত হচ্ছে লাখো মানুষ। পরিবেশের বাস্তুসংস্থান নষ্ট হওয়ায় ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অণুজীব থেকে শুরু করে বহু প্রাণীর অস্তিত্ব হয় বিলুপ্ত হয়েছে, অথবা বিলুপ্তি সংকটে পড়েছে। হারিয়ে গেছে প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল হরেক পেশা। হাজারো রকমের স্বাদু পানির মাছের জন্য বিখ্যাত অঞ্চলটিতে এখন দেশি মাছ নেই বললেই চলে। হারিয়ে গেছে বিখ্যাত ‘যশুরে কই’। কৃত্রিমভাবে চাষের মাধ্যমে হাতেগোনা কিছু দেশি মাছ রক্ষা করা গেলেও তা আগের স্বাদ হারিয়ে ফেলেছে।

জলবায়ু হয়ে উঠছে চরমভাবাপন্ন

একসময়ের সুজলা-সুফলা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকা এখন কার্যত মরুময়। জলবায়ু হয়ে উঠেছে চরমভাবাপন্ন। শীত মৌসুমের বেশিরভাগ দিন দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা থাকে যশোর ও চুয়াডাঙ্গায়। আবার গ্রীষ্মকালে বেশিরভাগ দিন সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ওঠে এই দুই জেলায়। চলতি গ্রীষ্ম মৌসুমে এখন পর্যন্ত দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা উঠেছে চুয়াডাঙ্গায়, ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৪১ ডিগ্রি তাপমাত্রা উঠেছে যশোরে।

যশোর-ঝিনাইদহ এলাকার খেজুরের রস-গুড় খুবই বিখ্যাত। কিন্তু নানা কারণে খেজুর গাছশূন্য হতে চলেছে এলাকাটি। মরুময়তার কারণে এখানে এখন আরবের খেজুরের বাণিজ্যিক উৎপাদনের চেষ্টা চলছে। জলবায়ু চরমভাবাপন্ন হয়ে ওঠায় জীবনের ওপর প্রভাব সাংঘাতিক। মানুষের জীবিকা দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে। উপকূলীয় এলাকা থেকে বহু মানুষ জীবিকার সন্ধানে স্থানান্তরিত হচ্ছে। পাশাপাশি সেখানে অপ্রচলিত ফসলের চাষ করে মানুষকে টিকিয়ে রাখতে গবেষণা চলছে।

হুমকির মুখে সুন্দরবন

সাইক্লোন-জলোচ্ছ্বাস থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষকে রক্ষার জন্য সুন্দরবন ঢাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আইলা ও সিডরের মতো অতিধ্বংসাত্মক সাইক্লোন থেকে উপকূলকে বুক দিয়ে আগলেছে সুন্দরবন। উজানের মিঠা পানির সরবরাহ হ্রাস এবং সাগরের লোনা পানির আধিক্য পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনটিকে হুমকির মুখে ফেলেছে। লোনা পানি বাড়ার কারণে সুন্দরবনের ইকোলজিক্যাল ব্যালান্সও নষ্ট হচ্ছে।

যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (যবিপ্রবি) পরিবেশবিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. নাজনীন নাহার বলেন, অতিরিক্ত লবণাক্ততা ম্যানগ্রোভ বনের উৎপাদনশীলতা হ্রাস করে। দীর্ঘ সময় ধরে উচ্চ লবণাক্ত পানিতে ডুবে থাকার ফলে গাছের অঙ্কুরোদ্গম কঠিন হয়ে পড়ে।

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর..
ফেসবুকে আমরা...
নামাজের সময়সূচী
জাতীয় সঙ্গীত
©সকল কিছুর স্বত্বাধিকারঃ Gen Z Bangladesh Online - জেন জি বাংলাদেশ অনলাইন | আমাদের সাইটের কোন বিষয়বস্তু অনুমতি ছাড়া কপি করা দণ্ডনীয় অপরাধ